Are you sure you want to report this content?
“আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির…” অর্ধঘুমন্ত রিয়া অস্পষ্টভাবে শুনতে পেল রেডিওতে বেজে চলা মা দুর্গার আগমনিবার্তা। স্বপ্নের মধ্যে রিয়া দেখল ওর হাতে রয়েছে ত্রিশূল, সামনে দৌড়ে আসছে একটা মহিষ। রিয়ার নিচের সিংহটা গর্জে উঠলো। সিংহবাহিনী রিয়া তেড়ে এগিয়ে গেলো মহিষাসুরের দিকে। মহিষাসুরের বুকে লক্ষ্য করে ত্রিশূলটা নিক্ষেপ করল রিয়া। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেল সে। কিন্তু সেটা তো অসুরের চিৎকার নয়, কোনো এক নারীকণ্ঠ, খুব চেনা নারীকণ্ঠ। ঘুম আর স্বপ্ন, দুটোই ভেঙে গেল রিয়ার। অসুর বধ করতে গিয়ে পাশে শুয়ে থাকা বোনের মুখে ঘুষি মেরে দিয়েছে সে। বেশ জোরেই মেরেছে সে, কারণ ওর বোন, দিয়ার নাক লাল হয়ে গেছে। দিদির উপরে বদলা নিতে গিয়ে দিয়াও রিয়ার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। তারপর শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে চুলোচুলি। অবশেষে তাদের মা, স্বপ্নাদেবীর হস্তক্ষেপে দুজনেরই কান্নার মাধ্যমে এই যুদ্ধ বন্ধ হলো।
এভাবেই শুরু হলো রিয়ার এবছরের দুর্গাপুজো। ওর কলেজে ওঠার পর প্রথম পুজো। নিজের পাড়ার পুজোর কথা কলেজের সবাইকে গর্ব করে বলে এসেছে সে। সেই শুনে ওর কয়েকজন বন্ধুও আসবে ওদের পুজো দেখতে।
মহালয়ার পরে দেখতে দেখতেই ষষ্ঠী চলে এলো। সেদিন দুপুরবেলা থেকে পুজোয় পাওয়া সব জামাকাপড় বের করলো রিয়া। পুজোর কয়েকদিন পাড়ার মেয়েদের মধ্যে সাজগোজের একটা নিঃশব্দ প্রতিযোগিতা হয়। তাছাড়া এখন সে আর স্কুলে পড়া বাচ্চা মেয়ে নয়, কলেজে পড়া বড়ো মেয়ে। মনের মধ্যে সেই সবরকম গণনা করে অবশেষে সন্ধ্যাবেলায় রিয়া একটা শাড়ি বাছাই করলো সেদিন পড়ার জন্য।
পাড়ার পূজা মণ্ডপে গিয়ে পাড়ার সব বন্ধুদের সাথে দেখা হলো, যাদের সাথে সারাবছর ইচ্ছাসত্বেও দেখা বা কথা হয়না কলেজের ব্যস্ততায়। এই পুজোর চারদিন এদের জন্য পুনর্মিলন উৎসবের মতো। সোনালী, রিক, মিনু, বাবলি, বান্টি, এরা সবাই একটা জায়গায় একসাথে ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে। সোনালী, রিক আর রিয়া সমবয়সী। সোনালী আর রিয়া একই কলেজে পড়ে। রিক আগের বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিনু আর বাবলি রিয়ার চেয়ে একবছরের বড়ো। বান্টি হলো বাবলির ভাই, সে মাধ্যমিক দিয়ে একাদশ শ্রেণীতে পরে। রিয়া আর দিয়া গিয়ে ওদের আড্ডায় যুক্ত হলো। কলেজ পড়ুয়ারা সবাই নিজের নতুন জীবন নিয়ে কথা বলছে। অন্যভাষায়, সবাই নিজের কলেজকেই সেরা প্রমাণ করতে ব্যস্ত। এই হাসিঠাট্টার মাঝেও রিয়ার মনে কিছু একটা খটকা লাগছিলো। অন্যবারের চেয়ে কিছু একটা যেন শূন্য শূন্য লাগছিলো, কিন্তু সেটা কি, সেটা বুঝতে পারছিলনা। সেদিনটা এরকমভাবেই কেটে গেল।
পরেরদিন সপ্তমী। সেদিন পাড়ার সবাই মিলে বেরোলো মণ্ডপদর্শনে। উদ্দেশ্য, হেঁটে হেঁটে আশেপাশের কয়েকটা মণ্ডপের ঠাকুর দেখা। সবাই হই-হুল্লোড় করতে করতে চললো। সবার সাথে মজা করতে করতেও রিয়ার মনে হলো যেন কিছু একটা কম। কিছু একটা, যা অন্যবার থাকে, কিন্তু এইবারে নেই। আশেপাশের জাঁকজমকের মধ্যেও রিয়ার মন শুধু সেই জিনিসটাকেই খুঁজে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে রিক বললো, “আচ্ছা, এবারে অনিন্দ্যদার কি খবর? এলোনা যে!” অনিন্দ্য হলো ওদের গ্রুপের আরেকজন সদস্য। যদিও বাকিরা কেউ ওকে বেশি সহ্য করতে পারেনা, কিন্তু মিনুর খুড়তুতো ভাই এবং তার প্রায় সমবয়সী হওয়ায় সে ওদের সাথেই থাকে পুজোতে। সাধারণত তার কাজ হলো অন্যদের জ্বালানো, ব্যঙ্গ করা। মিনুই উত্তরটা দিলো, “আরে তুই জানিসনা, ও তো এখন মুম্বইতে থেকে পড়াশোনা করে। কলেজ থেকে ছুটি পায়নি বলে এবারে আসবেনা।”
অনিন্দ্যর নামটা শুনতেই রিয়ার চমক ভাঙলো। বাকিদের মতো সেও অনিন্দ্যকে সহ্য করতে পারতোনা। তাই সে বললো, “যাক বাঁচা গেছে। ও না থাকাই ভালো। ভীষণ বিরক্তিকর।“ সবাই সেটা শুনে হোহো করে হেসে উঠলো। রিয়ার মনে পড়লো, অনিন্দ্য ওকে খুব বিরক্ত করতো। সবাইকেই করতো, কিন্তু ওকে যেন একটু বেশিই বিরক্ত করতো। কথায় কথায় চুল ধরে টানতো, নাক মূলে দিতো। এসব রিয়ার একদমই পছন্দ ছিলনা। অনিন্দ্যর কথা ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়লো আগের বছরের দশমীর কথা। প্রতিমা বিসর্জন সেরে এসে সবাই তখন শুভ বিজয়ার প্রণাম আর কোলাকুলিতে ব্যস্ত, তখনই অনিন্দ্য ওকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গেল। একটু নির্জন জায়গায় গিয়ে রিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল।
“কিরে রিয়া, কি ভাবছিস ওতো? আইসক্রিম তো গলে যাবে।“ সোনালীর কোথায় রিয়া অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো। হাতে থাকা আইসক্রিমটা খেতে শুরু করলো। আবার রিয়ার মনে পড়লো, আগের বছর এরকম আইসক্রিম খাবার সময় অনিন্দ্য ওর হাতে লেগে থাকা ক্রিমটা রিয়ার নতুন জামায় মুছে পালিয়েছিল। সেটা নিয়ে রিয়া খুব রাগারাগি করেছিল।
রাত্রে বাড়ি ফেরার পর রিয়ার মনে হলো, এবারে সব কিছুই যেন খুব সাধারণ হচ্ছে। অন্যবছর অনিন্দ্য থাকার জন্য সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা মশলাদার ব্যাপার থাকতো। রিয়ার আবার মনে পড়লো আগের বছরের কথাগুলো। সেদিন সে অনিন্দ্যর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। ছোটবেলার বন্ধু সম্বন্ধে এরকম ভাবনা কোনোদিন তার মাথাতেই আসেনি। তার ওপর আবার এমন একজনের প্রতি, যে তাকে সারাক্ষণ শুধু বিরক্ত করতো। সেদিন রিয়া তাকে খুব কড়া ভাষাতেই কথা শুনিয়েছিলো। পরে যদিও সেটা ভেবে রিয়ার একটু অপরাধবোধ হয়েছিল, কিন্তু সারাবছর আর অনিন্দ্যর দেখাই পায়নি সে।
রিয়া ফেসবুকে অনিন্দ্যর প্রোফাইল ঘেঁটে দেখতে লাগলো। ফ্রেন্ডলিস্টে অনেকদিন ধরে থাকলেও কোনোদিন তার সাথে কথা বলেনি রিয়া। দেখলো ছেলেটা মুম্বইয়ের একটা নামকরা কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। ফেসবুকে দুদিন আগেই পোস্ট দিয়েছে, “first time out of West Bengal during Durga Puja. Missing you guys” আরো পুরনো পোস্ট খুঁজতে খুঁজতে রিয়া আবিষ্কার করলো অনিন্দ্যর সাথে বেশ কয়েকটা সুন্দরী মেয়ে ছবি, সম্ভবত ওদেরই কলেজের। এবার ফোন বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো সে। কেন জানেনা, যাকে সে একবছর আগে ফিরিয়ে দিয়েছিল, আজ তাকেই ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। আবার ভাবলো, মুম্বইয়ের আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশ, ওতো সুন্দরী সহপাঠী, এসবের ভিড়ে কি আর অনিন্দ্য তাকে মনে রাখবে! এসব ভাবতে ভাবতেই রিয়া ঘুমিয়ে পড়লো।
পরের দিন অষ্টমী। অঞ্জলি দেওয়ার জন্য পাড়ার সব মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে মণ্ডপে উপস্থিত হলো। রিয়া লোকের মুখে শুনেছে, অঞ্জলির শেষে প্রার্থনায় মানুষ যা চায়, মা দুর্গা সেই সব মনস্কামনা পূরণ করে দেন। সেদিন সে এমন কিছু চেয়ে বসলো, যা কয়েকদিন আগে অবধি সে ভাবতেও পারতোনা। সারাদিন পাড়ার বন্ধুদের সাথে ঘুরে মণ্ডপদর্শন আর পরনিন্দা পরচর্চা করতে করতেই কেটে গেল।
পরের দিন নবমী। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রিয়ার কলেজের বন্ধুরা আসবে ওদের পাড়ার ঠাকুর দেখতে। রিয়া ইচ্ছে করেই ওদের নবমীর দিনে আসতে বলেছে, যাতে তাদের পাড়ার ধুনুচি নাচ দেখাতে পারে।
কলেজের বন্ধুদের সাথে নিজের পাড়ার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল রিয়া। সবাই উৎসাহিত হয়ে ধুনুচি নাচ দেখছে। রিয়ার যদিও ওতো উৎসাহ নেই। কারণ, অনিন্দ্য খুব সুন্দর ধুনুচি নাচ করতে পারতো। ধুনুচি নাচের সৌজন্যে রিয়া নবমীর সন্ধ্যাবেলায় অনিন্দ্যর বিরক্তি থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি পেত। এবছর অনিন্দ্য নেই, তাই ধুনুচি নাচের মধ্যে সেই উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছেনা সে। এমন সময়ে তার কলেজের একজন বলে উঠলো, “ওই ছেলেটা কে রে? দারুণ নাচ্ছে তো!”
কথাটা শুনে বাকি সবাই উদ্দিষ্ট ছেলেটির দিকে তাকালো, রিয়াও তাকালো। ছেলেটাকে দেখে রিয়া হতবাক হয়ে গেল! শুধু রিয়া নয়, সবাই হতবাক হয়ে গেল। তখনই মিনু বলে উঠলো, “সারপ্রাইজ! ওর কলেজ থেকে কোলকাতায় একটা সেমিনারের জন্য ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ সকালেই এলো।“
রিয়া তো অনিন্দ্যর থেকে চোখ সরাতেই পারছেনা, কিন্তু মিনুর কথাটা শুনে সে ফেসবুকে অনিন্দ্যর প্রোফাইল আরেকবার দেখলো। অনিন্দ্যর নতুন পোস্ট গতকাল রাত্রে, “মনে হয় মা দুর্গাও চাননা আমাকে ছেড়ে পুজো কাটাতে।”
ধুনুচি নাচের পর অনিন্দ্য এলো রিয়াদের কাছে। বাকি সবার সাথে কথা বললো, কিন্তু রিয়াকে এড়িয়ে গেলো। রিয়া অনিন্দ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, কিন্তু ওপ্রান্ত থেকে কোনো উত্তরসূচক চাহনি পেলোনা। রিয়ার সেদিন নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হলো। মনে হলো সারা পৃথিবী থেকে সে আলাদা। মন খারাপ ঢাকতে, শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে সে উঠে চলে এলো। ওঠার সময় আরও একবার দেখলো অনিন্দ্যর দিকে, কিন্তু তখনও সে অন্যদিকেই তাকিয়ে।
পরের দিন দশমী। সবার মুখে শোকের ছায়া, মা আজ চলে যাচ্ছেন। ঠাকুর বরণ, সিঁদুর খেলা, সব হল। বিসর্জন দিয়ে ফেরার সময়ে রিয়া আবার আগের বছরের স্মৃতিতে ডুব দিয়ে দিল। সবাই যখন শুভ বিজয়ার প্রণাম, কোলাকুলি করছে, তখন সবার অলক্ষ্যে রিয়া চলে গেল সেই জায়গায়, যেখানে আগের বছর অনিন্দ্য তাকে নিয়ে এসেছিল।
চোখ বন্ধ করলো রিয়া। মনে মনে আগের বছরের কথাগুলো পর পর ভাবতে লাগলো। সে কল্পনা করলো, অনিন্দ্য তার হাত ধরে বলছে, “এই শোন না রিয়া, তোকে কিছু বলার ছিল।“ তারপর অনিন্দ্য রিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, হাতে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে বললো, “আমি তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি রিয়া। তুই কি সারাজীবন আমার হাতে হাত রেখে চলতে রাজি?”
চোখ বন্ধ করে ভাবতে ভাবতেই রিয়া উত্তর দিলো, “আমিও তোকে খুব ভালোবাসি অনিন্দ্য…”
-সত্যি?
কথাটা শুনে চমকে গিয়ে রিয়া চোখ খুলে ফেললো। দেখলো, সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্য।
242 Launches
Part of the Love collection
Updated on October 08, 2018
(7)
Characters left :
Category
You can edit published STORIES
Are you sure you want to delete this opinion?
Are you sure you want to delete this reply?
Are you sure you want to report this content?
This content has been reported as inappropriate. Our team will look into it ASAP. Thank You!
By signing up you agree to Launchora's Terms & Policies.
By signing up you agree to Launchora's Terms & Policies.