Are you sure you want to report this content?
Illustration by @_ximena.arias
“দেশে মিললো আরও একজন নতুন করোনা আক্রান্তের খোঁজ। এদিকে কোলকাতার আইসলেশন থেকে পালিয়ে গেলেন এক তরুণ। আমরা চলে যাবো সরাসরি আমাদের প্রতিনিধির কাছে।” এটুকু শুনেই টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে সুস্মিতার মা, সারদাদেবী বললেন, “অবস্থা তো দিন দিন আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে! কি যে হবে, কে জানে!”
সেই সময়ের কথা বলছি, যখন সারা পৃথিবীতে করোনা নামক এক ভাইরাস ছড়িয়ে পরেছে। চীন, আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোকেও এই ভাইরাস নাস্তানাবুদ করে রেখেছে। ভাইরাসবাহক কোনো ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তিকে ছুলেই তার দেহে ঢুকে যাচ্ছে মারণরোগ। গবেষক, ডাক্তার, নার্সেরা প্রাণপণ চালিয়ে যাচ্ছে এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। রোগের সংক্রমণ আটকাতে সরকার থেকে নাগরিকদের বাড়ি থেকে বেরতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া আর কেউ বাইরে বেরচ্ছেনা। সারা দেশজুড়ে আতঙ্কের ছায়া।
“তুই রুটিগুলো বেলে দে তো, আমি সেঁকে দিচ্ছি” সারদাদেবী বললেন সুস্মিতাকে। সুস্মিতাদের বাড়িতে থাকে মোট তিনজন মানুষ সারদাদেবী, সুস্মিতা এবং তার বাবা শ্যামলবাবু। করোনার উৎপাতে সকল বিদ্যালয়, অফিস ছুটি। বাড়িতে বসে বসে টিভিতে সারাদিন এই আতঙ্কের খবর দেখা ছাড়া আর বিশেষ কোনো কাজ নেই। বিনোদন বলতে ওই অনলাইন সমাজ মাধ্যম আর মায়ের ঘরের কাজে সাহায্য করা।
একসময়ে এই একঘেয়ে জীবনে দমবন্ধ হয়ে আসছিল সুস্মিতার। কিন্তু অন্য কোনো উপায় নেই, কারণ বাইরে অদৃশ্য শত্রু ওঁত পেতে বসে আছে। শুধু সুস্মিতা বলে নয়, দেশের বেশীরভাগ মানুষেরই অবস্থা এইরকমই। যখন মানুষের কোনো কাজ থাকেনা, মানুষের মাথায় নেতিবাচক চিন্তাভাবনা চাগাড় দিয়ে ওঠে। সুস্মিতার মনে পড়ে যায় তার দিদি, শর্মিষ্ঠার কথা। শেষের দিনগুলো সে যেন চোখের সামনে দেখতে পায়! সেদিনকার প্রতি মুহূর্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা মনে পড়ে তার।
দিনটা ছিল পয়লা মার্চ। শীতের প্রভাব কমেছে, ধীরে ধীরে বসন্তের নতুন কচি পাতা গজাতে শুরু করেছে গাছে। সেইদিন শর্মিষ্ঠার জন্মদিন। সকাল থেকেই খুব খুশী ছিল সে। সন্ধ্যাবেলায় বন্ধুমহলে জন্মদিন পালন করার জন্য বেরিয়েছিল সে। রাত্রে ফিরে আসা অবধি সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল।
শ্যামলবাবুর ঘুম খুব কাঁচা, অল্প আওয়াজেই ভেঙ্গে যায়। রাত্রে শর্মিষ্ঠার ঘর থেকে কিছু একটা পরে যাওয়ার আওয়াজ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। ভাবলেন মেয়ের ঘরে গিয়ে একবার দেখবেন কি ব্যাপার। কিন্তু গিয়ে দেখলেন ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! শর্মিষ্ঠা সাধারণত দরজা বন্ধ করে রাখেনা। শ্যামলবাবু বেশ কয়েকবার দরজায় টোকা মারলেন। বাকিদের ঘুম অব্যাহত রাখার জন্য জোরে ডাকছিলেননা। কিন্তু, ভেতর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে তিনি মেয়েকে ফোন করবেন ভাবলেন। ফোন বন্ধ! ঠাণ্ডার মধ্যেও ধীরে ধীরে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো। এবারে নাম ধরে জোরে ডেকে উঠলেন। তাও কোনো সারা পাওয়া গেলনা ভেতর থেকে। এরকম কয়েকবার ডাকার পরে সারদাদেবী ও সুস্মিতা ঘুম থেকে উঠে চলে এলো, কিন্তু ঘরের ভেতর তখনও নিস্তব্ধ। এবারে সত্যি সত্যি তাদের মনে ভয় ধরতে শুরু করে দিলো। শ্যামলবাবু জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন, এতটাই জোরে, যে একসময়ে দরজা ভেঙে গেলো এবং শ্যামলবাবু হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে যা দেখলেন, সেটা দেখে তার চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইলো। তাও দৌড়ে গিয়ে নিচ থেকে ওপরের দিকে তুলে ধরলেন পাখা থেকে ঝুলন্ত শর্মিষ্ঠার দেহটা। তিনজনের চেষ্টায় তাকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। সারদাদেবী কাঁপা কাঁপা হাতে নাকে এবং বুকে হাত দিয়ে দেখলেন শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃৎস্পন্দন তখনও চলছে। সাথে সাথে হাসপাতালে খবর দেওয়া হলো। শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
ডাক্তারদের চেষ্টায় প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শর্মিষ্ঠার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গেলো চিরকালের জন্য। এখন তার স্থান মানসিক চিকিৎসালয়ে। আগে প্রতি মাসে একবার করে সুস্মিতারা দেখতে যেত তাকে। কিন্তু, এইমাসে যাওয়া হয়নি। সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা মনে পড়লে সুস্মিতার চোখ থেকে জল পরতে থাকে। ঘুমের মধ্যেও সেই স্মৃতি তাকে তাড়া করে। তাই, শর্মিষ্ঠার ঘর এখন খালি থাকলেও সে সেখানে শুতে চায়না।
এই স্মৃতি থেকে বাঁচতে সে এখন অন্যদিকে মন লাগানোর চেষ্টা করে। ফেসবুকে একজন ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছে তার। সারাদিন-রাত কথা হয়। ভালই চলছিলো সবকিছু। ছেলেটা তার থেকে বয়সে বেশকিছু বছরের বড়ো হলেও সুস্মিতার প্রতি সে অনেক উৎসাহিত ছিল। দিদির সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার এতদিন পরে শেষমেশ মেয়ের মুখে হাসি ফুটেছে দেখে তার মা বাবাও বেশ খুশী ছিলেন।
ওইদিকে দেশের সরকার থেকে সবরকম চেষ্টার পরেও করোনার মারণদৃষ্টি থেকে বাঁচা ক্রমশঃ খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কিছু কিছু লোক এখনও সরকারকে অমান্য করে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মাধ্যমেই আরও ছড়াচ্ছে ভাইরাস। সরকার থেকে নানারকম চেষ্টা করা হচ্ছে লোককে বোঝানোর, সচেতন করার। কিন্তু, কিছু লোক শোনবার পাত্র নয়। অন্যদিকে রোগী রাখার জন্য হাসপাতালে জায়গা কমে আসছে, সবাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। অনেকেই মনে করছে, এই হয়তো শেষ!
সুস্মিতা ভাবল, একবার দেখা করা যাক ছেলেটার সাথে, পড়ে যদি আর সুযোগ না মেলে! কিন্তু, এই অবস্থায় ছেলেটা দেখা করতে চাইবে কিনা, সেই বিষয়ে সে নিশ্চিত ছিলোনা। তবে মনঃস্থির করে একদিন জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, “সৌরভ, আমার না খুব ভয় করছে”
-কেন সোনা? ভয় কিসের? আমি তো আছি।
-চারিদিকে যা সব ঘটছে, সেগুলো দেখে ভয় করছে। আমাদের যদি আর দেখাই না হয়! যদি তার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়!
-না সোনা। আমাদের কিচ্ছু হবেনা।
-আমি তোমার থেকে যদি কিছু চাই, তুমি দেবে তো?
-হ্যাঁ সোনা, নিশ্চয়ই। তোমার জন্য চাঁদ তারা নিয়ে আসতে পারি আমি।
-তাহলে একদিন দেখা করতে পারবে আমার সাথে কয়েকদিনের মধ্যে?
-এই এখন! কিন্তু এখন তো বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ।
-না, আমি এখনই দেখা করতে চাই।
-আচ্ছা ঠিক আছে, কবে দেখা করবে বলো, আমি ব্যবস্থা করছি।
-এই রবিবার?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
দেখতে দেখতে রবিবার চলে এলো। গঙ্গার ধারের বেঞ্চে বসে আছে সৌরভ। আশেপাশে পুরো ফাঁকা, কোনো মানুষ নেই। সেইদিনের পরে সুস্মিতার সাথে তার আর কোনো কথাই হয়নি। রহস্যজনকভাবে সে উধাও হয়ে গেছে। তাও সৌরভের মন বলছে আজ সে আসবে। ফেসবুকে ছবি দেখার পর থেকেই তাকে দেখার ইচ্ছা ছিল সৌরভের। কিন্তু, পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় সেটা সম্ভব হয়নি। নয়তো অনেক আগে থেকেই সে নিজেই বলতো দেখা করতে।
সৌরভ গঙ্গার দিকে মুখ ঘুরিয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিল, এমন সময়ে পিঠে একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাল। সুস্মিতা দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভ বলল, “আমি তো ভাবলাম তুমি আসবেনা!”
-(মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে) আচ্ছা? সেইরকমই যদি ভাবলে, তাহলে তুমি এখানে বসে রয়েছ কেন?
-তোমার ভরসায়।
সুস্মিতা সৌরভের পাশে এসে বসতেই সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, “আগে বলো তো, এই কদিন কথায় পালিয়ে গেছিলে?”
কথাটা শেষ হতে না হতেই সুস্মিতা ঠোঁট দিয়ে সৌরভের ঠোঁট চেপে ধরল। দুজনেরই চোখ বন্ধ হয়ে গেলো ফরাসী চুম্বনের আবেশে। দুজনেই চাইছিল এই মুহূর্তটা যেন শেষ না হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই পেছন থেকে কয়েকজন লোক এসে, টেনে দুজনকে আলাদা করে দিলো। সৌরভ পেছন ফিরে দেখল বেশ কয়েকজন পুলিশ ও মহিলা পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা তাদের দুজনকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। সৌরভ বিরক্ত হয়ে বলল, “একই! কি করছেন কি? ছেড়ে দিন আমাকে।” একজন পুলিশ বলল, “চারদিন আগে ওই মেয়েটার শরীরে করোনা ধরা পরেছে। আজ আইসোলেশন থেকে পালিয়ে এসেছে এখানে। আর এসেই তোমাদের যা কান্ড দেখলাম, তোমার শরীরেও এতক্ষণে চলে গেছে। তোমাদের আমাদের সাথে হাসপাতালে যেতে হবে।”
এই কথাটা শুনে সৌরভের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো! সুস্মিতার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “সোনা, তুমি আমার সাথে এইরকম কেন করলে?” সুস্মিতার ঠোঁটের ফাঁকে হাল্কা হাসি ফুটে উঠলো। সে বলল, “শর্মিষ্ঠাকে মনে আছে? আমি তারই বোন।”
সেইরাতে শর্মিষ্ঠাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন শ্যামলবাবু। সারদাদেবী ও সুস্মিতা বাড়িতেই ছিল। সুস্মিতা জানতো তার দিদি রোজ ডায়েরি লিখতো। সে সেই ডায়েরি খুলে দেখল, শেষ পাতায় লেখা, “সৌরভ, তুমি আমার সাথে এইরকম কেন করলে?”
162 Launches
Part of the MyPlotTwist collection
Updated on March 25, 2020
(4)
Characters left :
Category
You can edit published STORIES
Are you sure you want to delete this opinion?
Are you sure you want to delete this reply?
Are you sure you want to report this content?
This content has been reported as inappropriate. Our team will look into it ASAP. Thank You!
By signing up you agree to Launchora's Terms & Policies.
By signing up you agree to Launchora's Terms & Policies.